করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রনের প্রভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পাশাপাশি দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যেও ফের অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। ধরনটির সংক্রমণ কমাতে দেশে বিধিনিষেধ চালু হয়েছে। প্রতিবেশী ভারতসহ অনেক দেশে লকডাউন দেওয়া হয়েছে। এসবের প্রভাব পড়েছে দেশের রপ্তানি খাতে। নতুন রপ্তানি আদেশ কমেছে। রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা কমেছে। একই ভাবে কাঁচামাল আমদানিও হ্রাস পেয়েছে। সার্বিকভাবে পণ্য আমদানির এলসি খোলা কমেছে।
এ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ওমিক্রনের কারণে দেশের প্রধান রপ্তানির বাজার ইউরোপ, আমেরিকার অনেক দেশে লকডাউন চলছে। ফলে ওইসব দেশ থেকে এখন নতুন রপ্তানির আদেশ কমে গেছে। এ কারণে তারা রপ্তানি পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে ব্যাক টু ব্যাক এলসির খোলাও কমিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য আমদানিও কমেছে। কারণ ওমিক্রনের প্রভাব কোথায় গিয়ে ঠেকে তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। যে কারণে ব্যবসায়ীরা একটু ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করেছেন। কেননা এর আগে করোনার দুদফা আঘাতে ক্ষতি এখনও কাটিয়ে উঠা সম্ভব হয়নি।
এদিকে সরকার বিধিনিষেধ আরোপের পর প্রথম ধাক্কা লেগেছে পর্যটন শিল্পে। পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের আগমন কমে গেছে। যে জন্য মোটেল ভাড়ায় ৫০ শতাংশ ছাড় দিয়েও অর্ধেক লোক পাচ্ছে না। পাশাপাশি পর্যটন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য শিল্পেও নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে।
এদিকে ওমিক্রনের সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রপ্তানির বিপরীতে চারটি প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ জুন পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণ পরিশোধের সময় আগামী জুন পর্যন্ত বাড়াতে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পক্ষ থেকে সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানোসহ ডলারের বিপরীতে টাকার আরও অবমূল্যায়ন করার দাবি করেছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, নভেম্বর পর্যন্ত আমদানি বেড়েছে। কিন্তু ওমিক্রনের প্রভাবে ডিসেম্বর থেকে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা হয় ২০ কোটি ডলারের। শেষ সপ্তাহে তা কমে মাত্র ৫ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রথম সপ্তাহের তুলনায় পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম সপ্তাহেও ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা কমেছে।
এদিকে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানিও কমতে শুরু করেছে। নভেম্বর পর্যন্ত এ খাতে আমদানি বেড়েছিল। কিন্তু ডিসেম্বর থেকে কমতে শুরু করেছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় আমদানি হয়েছিল ১৫ কোটি ডলার। শেষ সপ্তাহে হয়েছে ৭ কোটি ৬৪ লাখ ডলার।
রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসি খুলতে হয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তত কারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিমের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি বলেন, কয়েক মাস আগেও যেভাবে অর্ডার এসেছে, ওমিক্রনের সংক্রমণ বৃদ্ধিতে তা কমতে শুরু করেছে। পুরোনো অর্ডার নিয়ে এখন গার্মেন্ট মালিকরা চিন্তিত। তবে আশার কথা হচ্ছে, এখনো অর্ডার বাতিল করার কোনো খবর আসেনি। বিদেশি ক্রেতারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন বলে মনে হয়।
তিনি আরও বলেন, ওমিক্রনের ভীতির কারণে কারখানায় পোশাক শ্রমিকদের উপস্থিতির সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে পোশাক তৈরিতে ধীর গতি দেখা দিয়েছে। রপ্তানিতে এটিও একটা সতর্ক সংকেত হতে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, রপ্তানির কাঁচামাল ছাড়াও সার্বিকভাবে আমদানির এলসি খোলাও কমেছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এলসি খোলা হয়েছিল ১৩৬ কোটি ডলার। শেষ সপ্তাহে খোলা হয়েছে ৪৩ কোটি ডলারের এলসি। একই সময়ে আমদানি ১১৪ কোটি ডলার থেকে কমে ৫৭ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়াও সিমেন্টের কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানির জন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এলসি খোলা হয়েছিল ২ কোটি ২১ লাখ ডলারের এবং আমদানি হয়েছিল ৯৬ লাখ ডলারের। শেষ সপ্তাহে এলসি খোলা হয়েছে ৮২ লাখ ডলারের এবং আমদানি হয়েছে ১ কোটি ২৩ লাখ ডলারের। বিপি শিট আমদানির জন্য ডিসেম্বরের সপ্তাহে এলসি খোলা হয়েছিল ৩৩ লাখ ৫০ হাজার ডলারের। শেষ সপ্তাহে খোলা হয়েছে ২ লাখ ডলারের। রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ভেসেল বা পুরোনো জাহাজ আমদানির জন্য ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে এলসি খোলা হয়েছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। শেষ সপ্তাহে এ খাতে কোনো এলসি খোলা হয়নি।
একই সময়ে তুলা আমদানির এলসি ৬ কোটি ৪৫ লাখ ডলার থেকে ৩ কোটি ২৩ লাখ ডলারে নেমেছে। সিনথেটিক বা মিক্সড ইয়ার্ন আমদানির এলসি ১ কোটি ৭৪ লাখ ডলার থেকে কমে ১ কোটি ১৩ লাখ ডলার হয়েছে। সুতা আমদানির এলসি ৬ কোটি ৫১ লাখ ডলার থেকে কমে ২ কোটি ৯৩ লাখ ডলার হয়েছে।
টেক্সটাইলের কাপড় আমদানির এলসি ২ কোটি ৭৫ লাখ ডলার থেকে কমে ৪ লাখ ডলারে নেমেছে। ২ কোটি ডলার থেকে কমে ৫৫ লাখ ডলারে নেমেছে টেক্সটাইল এক্সেসরিজের এলসি খোলা।
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ওমিক্রনের প্রভাবে রপ্তানির আদেশ আগের চেয়ে কমেছে। তবে আগের যেসব আদেশ আছে সেগুলো কেউ বাতিল করেনি। ওইসব অর্ডার দিয়ে এখন কারখানা চলছে। বিদেশ থেকে আগের রপ্তানির মূল্য দেশে আসা এখন কমেছে। কারণ অমিক্রনের প্রভাবে অনেক দেশে আবার লকডাউন দিয়েছে। এ কারণে নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে।
এদিকে শনিবার ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতির ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) ভবনে ব্যবসায়ীদের এক সভা হয়েছে। এতে সংগঠনের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, করোনা মহামারির মধ্যে এখনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর মধ্যে ওমিক্রনের প্রভাবে আবারও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এমন অবস্থায় ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় কমপক্ষে জুন পর্যন্ত না বাড়ালে ৫০ শতাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে যাবেন। ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখার স্বার্থে জুন পর্যন্ত ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময় বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন তিনি।
সভায় ব্যবসায়ীরা বলেন, করোনার দ্বিতীয় ধাক্কার পর এখন ওমিক্রনের সংক্রমণে আবারও ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এমন অবস্থায় অনেক ব্যবসায়ীর ঋণের কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা নেই। ঋণ পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সময় না বাড়ালে ঋণগ্রহীতাদের অনেকেই খেলাপি হবেন, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর হবে।
ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকাতে বিধিনিষধ আরোপের প্রথম ধাক্কা এসেছে পর্যটন খাতে। কক্সবাজারসহ বিভিন্ন পর্যটন এলাকাগুলোতে পর্যটকদের আগমন কমে গেছে। এর প্রভাবে ওইসব এলাকায় হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ব্যবসায় নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. আকবর উদ্দিন আহমেদ বলেন, ওমিক্রণের সংক্রমণ এখনও ইউরোপ, আমেরিকা, থাইল্যান্ড, ভারতসহ অনেক দেশে বাড়ছে। এ কারণে বিদেশে পর্যটক যাওয়া ও বিদেশ থেকে আসা অনেক কমে গেছে। দেশের পর্যটকও কমেছে। সরকার নতুন আইন করেছে হোটেলে থাকতে ও খেতে টিকার সনদ দেখাতে হবে। বাস্তবে এ সনদ অনেকেরই নেই। সনদ ছাড়া হোটেলে খাওয়ার কারণে চট্টগ্রামে ভ্রাম্যমাণ আদালত কয়েকটি হোটেলকে জরিমানা করেছেন। ফলে এখন পর্যটক আরও কমবে।
তিনি বলেন, স্বাভাবিকের তুলনায় এখন ১০ শতাংশ পর্যটকও পাওয়া যাচ্ছে না। দ্রুত অমিক্রনের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার দাবি করেন তিনি। তা না না হলে এ খাতে বড় বিপর্যয় নেমে আসবে।
সূত্র : যুগান্তর
Discussion about this post