প্রস্তাবিত বাজেটে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার ইস্যুতে সরকারি ও বিরোধী দলীয় নেতাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল জাতীয় সংসদ অধিবেশন।
বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা এই সুযোগকে ‘অনৈতিক’ বলে আখ্যা দেওয়ার পর সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা বলেন, খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ছাড়া আর কারও অর্থ পাচারের তথ্য কেউ জানে না।
গতকাল মঙ্গলবার সংসদের বৈঠকে ২০২২-২৩ নতুন অর্থ বছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তারা এসব কথা বলেন। গত ৯ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে এই বাজেট উপস্থাপন করেন। এর আগে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের বৈঠক শুরু হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান বলেন, টাকা পাচারকারীদের অর্থ নিরাপাদে ফিরিয়ে আনার জন্য এই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে। সুবিধাভোগী এবং কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যবসায়ীকে অর্থ পাচারে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অর্থ পাচারকারীদের শাস্তি না দিয়ে নামমাত্র কর দিয়ে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব অনৈতিক। অবৈধ অর্থ ঢালাওভাবে বৈধ করার সুযোগ দেওয়া অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, নৈতিক কোনো দিক থেকে সমর্থনযোগ্য নয়।
তিনি টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার দাবি জানান।
প্রস্তাবিত বাজেটকে উচ্চাভিলাষী আখ্যা দিয়ে বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, এই বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য কমানোর কার্যকরী কোনো কৌশল এই বাজেটে নেই।
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘এটি অনৈতিক বাজেট, এখানে পাচার করা টাকা বিনা প্রশ্নে দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাই এটা অনৈতিক বাজেট।’
সরকারি দলের সদস্য ও সাবেক প্রাথমিক-গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান তার বক্তব্যে প্রশ্ন রাখেন কারা টাকা পাচার করেছে, কোথায় পাচার করেছে।
তাদের নাম জানতে চেয়ে তিনি বলেন, আমি একজনের কথা জানি যার পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তিনি বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়ার কনিষ্ঠ পুত্র আরাফাত রহমান কোকো।
‘বিপুল ঘাটতির বাজেট’
প্রস্তাবিত বাজেটকে ‘বিপুল ঘাটতির বাজেট’ হিসেবে উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামিম হায়দার পাটোয়ারী।
তিনি বলেন, ‘৯৮ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহ করার কথা বলা হয়েছে। এটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। এই বাজেটের ফলে ব্যাংক, কর্মসংস্থান ও ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণ চাপে পড়বে।’
তিনি করমুক্ত আয়সীমা ৫ লাখ করা, এনবিআরের সক্ষমতা বাড়নো, কর সক্ষমতা বাড়ানো, প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা ৫ শতাংশ করা, প্রবাসীদের পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা করা, দক্ষ জনবল তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করেন।
জাপার এই সংসদ সদস্য বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কূটনীতিক রিপোর্টারদের বলেছেন, মর্কিন রাষ্ট্রদূতকে কী কী প্রশ্ন করতে হবে। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো ফরেন মিনিস্টার এভাবে তার দেশের সাংবাদিকদের এরকম অনুরোধ করেছেন তার দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, তার দেশের গুম, তার দেশের ভোটিং নিয়ে প্রশ্ন করতে বলেছে তিনি তা শুনেননি।
তিনি বলেন, অন্তর্ভুক্তি অংশগ্রহণের মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতি করতে হবে। এখন আমরা চীন, ইন্ডিয়া, ইউএসএ এই ট্রায়লাটারিজমের মধ্যে পড়ে গেছি। ঐকমত্য ছাড়া এই ট্রায়লাটারিজমের মধ্যে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হবে না।
মঙ্গলবার প্রথম দিনের আলোচনায় আরো অংশ নেন রমেশ চন্দ্রসেন, হাবিবে মিল্লাত, আব্দুস সোবহান গোলাপ, আরমা দত্ত, আনোয়ারুল আবেদিন খান, নাজিম উদ্দীন ও সাইফুজ্জামান শেখর বক্তব্য দেন।
‘আমরা আইন প্রণয়ণ করি, কিন্তু তার সুফল কত জনে পান’
প্রস্তাবিত বাজেটে বায়ু দূষণ হ্রাস ও সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপের বিষয়গুলো উল্লেখ না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন ঢাকা-৯ আসনে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী।
তিনি বলেন, ‘বাজেটে অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে। তবে এই বাজেটে বায়ু দূষণের বিষয়টির স্থান পায়নি। সড়ক দূর্ঘটনা কীভাবে কমানো হবে তাও অনুপস্থিত।’
আদালতে মামলার জট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে আইন প্রণয়ন করি কিন্তু তার সুফল জনগণ কতটুকু পাচ্ছেন? আদালতের দিকে তাকালে দেখা যাবে ২৯ লাখ মামলা ঝুলে আছে। যেগুলো নিষ্পত্তি হয়নি। বাজেটে এই বিষয়ে আমরা উদ্যোগ ও নির্দেশনা দেখতে চাই।’
তামাক নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে সরকারি দলের এই সদস্য বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৬০ হাজার মানুষ অকালে মারা যান তামাকের কারণে। প্রতি বছর সিগারেটের মূল্য বাড়িয়ে তার ওপর করারোপ করা হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলো উৎপাদন খরচ না বাড়িয়ে বেশি টাকা লাভ করছে। এতে সরকারের তিন হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু যেভাবে চলছে তাতে ২০৮০ সালেও দেশ তামাক মুক্ত হবে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা তো তামাক কোম্পানির মুনাফা বাড়াতে সংসদে আসিনি।’
সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমরা তো সরকারি দলের। আমি নৌকার টিকিট নিয়ে নির্বাচিত হয়েছি। সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তের পাশে আমি আছি। সেটা আমি সমর্থন করছি। কিন্তু এ ধরনের পরিস্থিতি যখন আসে তখন আমাদের চুজ করতে হয়। প্রাথমিক যে প্রস্তাবনা অর্থমন্ত্রী এনেছেন, সেখানে স্পষ্টত কনফ্লিক্ট আছে। এই প্রস্তাবনা সংবিধান, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা, ফেমওয়ার্ক অব টোবাকো কনভেনশন এবং আপিল বিভাগের রায়ের সাথে। তাহলে আমরা কী করবো। আমরা কী ভোটদান থেকে বিরত থাকবো? আমরা তো সেটা চাই না। আমরা তো অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবনার সাথে শতভাগ সমর্থন করতে চাই।’
জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শামিম হায়দার পাটোয়ারীও তামাক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বলেন, ‘এই বাজেট বৃহৎ ব্যবসাবান্ধব বাজেট। এটি প্লাস্টিকবান্ধব বাজেট। এটি তামাক কোম্পানিবান্ধব। এই বাজেট সমস্যা সমাধানের বাজেট নয়, গণমুখী নয়।
সূত্র: সমকাল
Discussion about this post