বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন মার্কিন গণমাধ্যম দ্য ওয়াশিংটন পোস্টে। উত্তর ভার্জিনিয়ার রিটজ-কার্লটন হোটেলে অবস্থানকালে তার সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট পেটুলা ডিভোরাক। সেখানে বেশ কয়েকটি মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে গণমাধ্যমটির ‘পার্সপেক্টিভ’ প্রতিবেদনে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করতে সেই হোটেলে বাবার সাথে চলে এসেছিল ৬ বছর বয়সী কন্যা যোয়া। একজন ‘মহিলা’ রাষ্ট্রপ্রধান দেখাই ছিল তার আগ্রহের মূলে, যা কিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও অদূর ভবিষ্যতে দেখা যাবে কিনা, বলা মুশকিল। এছাড়া, শেখ হাসিনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আলোচিত একটি মিম’র ব্যাপারে। মিমটা দেখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে ফুটে ওঠে হাসি। বলেন, এই মিম তাকে আরও বেশি অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল।
রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া এবং জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের বিবেক জাগ্রত করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ প্রদানের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবস্থান করছিলেন উত্তর ভার্জিনিয়ার রিটজ হোটেলে। ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট পেটুলা ডিভোরাক তার প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গে বলেছেন, এই নারী মানেই শক্তি। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী মহিলা সরকারপ্রধান হওয়ার পাশাপাশি, রাশিয়ার চেয়ে বেশি জনসংখ্যার একটি দেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি। অন্তত ২০টি হত্যা প্রচেষ্টা থেকে বেঁচে গেছেন শেখ হাসিনা। বিশেষ করে, মানববর্ম তৈরি করে তাকে বাঁচাতে গিয়ে সকাতরে প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে তার পাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মানুষ।
এমন লৌহমানবী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত জীবনে একজন দাদীও বটে, যিনি রান্না করে খাওয়ান নাতনীকে! তার ৭৬তম জন্মদিনটি ছেলে এবং তার ১৬ বছর বয়সী নাতনির সাথে উদযাপন করেছেন। কীভাবে একজন মানুষ এতগুলোর কাজের মধ্যে থেকেই দাদী হিসেবে নাতনীর সাথে সময় কাটাতে পারে! এমনটিই জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে। শেখ হাসিনা হেসে বলেন, আমি তাদের জন্য চিকেন বিরিয়ানি রান্না করি। আমার ছেলের বাড়িতে কেবল আমার নিজের জন্যই একটি রান্নাঘর আছে।
টাইসন কর্নার হোটেল রুমে তাদের সাক্ষাৎকারের সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সেলফি তুলেছেন পেটুলা ডিভোরাক। প্রতিবেদনে ওয়াশিংটন পোস্টের কলামিস্ট লিখেছেন, আমরা প্রধানমন্ত্রীর অনুবাদক এবং চিফ অফ স্টাফের সাথে একটি সুন্দর ঘরে বসেছিলাম। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর পিতা বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের একটি বিশাল প্রতিকৃতিও ছিল। শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি এবং প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী; যাকে ১৯৭৫ সালে তার পরিবারের আরও ১৭ জন সদস্যের সাথে হত্যা করা হয়। আর তার উত্তরাধিকার ধরে রেখেছেন শেখ হাসিনা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাতিসংঘে শেখ হাসিনা মিয়ানমারের জাতিগত সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য সাহায্য চেয়েছেন। সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, শরণার্থীর জীবন কখনোই প্রত্যাশিত নয়। তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চায়।
পেটুলা ডিভোরাক বলেন, বাংলাদেশের অভিবাসী পরিস্থিতির সাথে যে আমেরিকার তুলনা চলে না, সে ব্যাপারে বলেছেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আমেরিকা বিশাল দেশ। প্রচুর জমি, প্রচুর জায়গা, কাজ করার সুযোগ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কেন অভিবাসীদের নিয়ে চিন্তিত হতে হবে?
জনসংখ্যার দিক নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ৮ নম্বরে রয়েছে। দেশটির জনসংখ্যা ১৭১ মিলিয়নেরও বেশি। শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের দেশটি আয়তনে খুবই ছোট। প্রধানমন্ত্রীর চিফ অফ স্টাফ বলেন, বাংলাদেশের আয়তন উইসকনসিনের সমান।
‘পার্সপেক্টিভ’ নামক প্রতিবেদনে এসেছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক তদন্তের সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ। সেই সাথে, দেশটিতে রয়েছে বাকস্বাধীনতার ব্যাপারে অভিযোগ। শেখ হাসিনার প্রশাসন কর্তৃক দেশের ভেতর সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করছে পুলিশ বাহিনী- এমন অভিযোগ আনা হয়েছে। তবে, ‘একজন মহিলা হওয়া সত্ত্বেও’ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করে ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। মোদি বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে ভারতের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জবাব দিয়েছিলেন, পুরুষদের চেয়ে নারীরা সব সময়ই এগিয়ে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই প্রত্যুত্তর বেশ সাড়া ফেলেছিল ২০১৫ সালে। পেটুলা ডিভোরাক সেই প্রসঙ্গ তুললে আবারও হেসে শেখ হাসিনা বলেন, নারীরা সবসময়ই পুরুষদের চেয়ে এগিয়ে।
কিন্তু সত্যিই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এগিয়ে গেছেন। দেশকে এগিয়ে নিয়েছেন। কারণ, তিনি একজন নারী। বাংলাদেশের দারিদ্র্য এবং শিক্ষার সংগ্রামে বেশিরভাগ মহিলারা যে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন এবং কীভাবে তাদের স্থবিরতা একটি জাতির অগ্রগতিকে মন্থর করে দিতে পারে তা শেখ হাসিনা আরও গভীরভাবে বোঝেন। গত এক দশকে শেখ হাসিনা তার দেশে দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্যভাবে কাজ করেছেন। শিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করেছেন এবং আবাসন ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেছেন। শেখ হাসিনা বলেন, এখন আর দেশে কুঁড়েঘর দেখা যায় না। পাকা বাড়িতে থাকতে পারে মানুষ। আবাসনকে একটি মানবাধিকারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে বাংলাদেশ। আর সরকারি এই আবাসন প্রকল্পের মালিকানা পুরুষ এবং মহিলার নামে হবে। আর স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে মহিলার মালিকানা থেকে যাবে, লোকটির নয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধিতে উচ্চ ধারণা পোষণ করেছে বিশ্বব্যাংক। উল্লেখ করেছে যে, ১৯৭১ সালে জন্মের সময় দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে একটি ছিল বাংলাদেশ। আর এখন সেই অবস্থান থেকে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পৌঁছেছে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে।
গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ভাষণে শেখ হাসিনা এসব কথা বলার পর স্বাভাবিকভাবেই ভাবা হয়েছিল, তার সফরের পরবর্তী অংশ হয়তো অনেকটা শান্তভাবেই সম্পন্ন হবে। কিন্তু না! তার কথা ছড়িয়ে গেছে ওই এলাকার বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে। এবং যখন তিনি পেটুলা ডিভোরাকের সাথে সাক্ষাৎকারটি শেষ করেছিলেন, তখন হোটেলের লবি কানায় কানায় ভর্তি শেখ হাসিনার ভক্তদের দ্বারা।
সূত্র : যমুনা টিভি
Discussion about this post