সুন্দরবনে গত সাড়ে পাঁচ মাসে দুটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যুতে ব্যাপক কৌতুহল সৃষ্টি হয়েছে পরিবেশ সচেতন মানুষের মাঝে ভাবিয়ে তুলেছে বনবিভাগকেও। গত সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের কোকিলমনি বন অফিসের কবরখালী খালের চর থেকে একটি বাঘিনীর (মাদী) দেহাবশেষ উদ্ধার করে বনরক্ষীরা। বনবিভাগের দাবি বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
আজ মঙ্গলবার দুপুরে শরণখোলা রেঞ্জ অফিস চত্বরে মৃত্যুরহস্য উদঘাটনে বাঘিনীর দেহাবশেষের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে। পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে নমুনা। ময়না তদন্ত করেন মোরেলগঞ্জ উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. জিএম আব্দুল কুদ্দুস। এসময় শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহিন, শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন, প্রেসক্লাবের সভাপতি ইসমাইল হোসেন লিটনসহ গণমাধ্যম কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। এঘটনায় তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বনবিভাগ।
এর আগে ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট বনের ছাপড়াখালী এলাকা থেকে আরেকটি বাঘের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। ওই বাঘটির মৃত্যুও স্বাভাবিকভাবে হয়েছে বলে বনবিভাগের ফরেনসিক ল্যাবের রিপোর্ট এবং সিআইডির রিপোর্টেও উল্লেখ করা হয়েছে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার কোকিলমনি টহল ফাঁড়ির বনরক্ষীরা নিয়মিত টহলকালে কবরখালী খালের চরে পড়ে থাকা একটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মৃত্যুদেহ উদ্ধার করে। বাঘটির পেট থেকে পেছনের সম্পূর্ণ অংশ কুমিরে খাওয়া। পরে বাঘের দেহাংশ শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে এনে ময়না তদন্ত শেষে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে।
গত পাঁচ মাসে দুটি মাঘের মৃত্যুতে উদ্বেগ প্রকাশ করে শরণখোলা সুন্দরবন সুরক্ষা কমিটির আহবায়ক নজরুল ইসলাম আকন বাগেরহাট২৪কে বলেন, পর পর দুটি বাঘের মৃত্যু একেবারেই স্বাভাবিকভাবে হয়েছে সেটাও চিন্তার বিষয়। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বনের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। একারণেও বাঘের জীবনাচরণ বাধাগ্রস্ত হয়ে বাঘ মারা পড়তে পারে। এ ব্যাপারে বনবিশেষজ্ঞদের ব্যাপক গবেষনার মাধ্যমে সঠিক রহস্য উদ্ঘাটন করা উচিৎ।
সুন্দরবন সহব্যবস্থা কমিটির (সিএমসি) সহসভাপতি মো. আব্দুল ওয়াদুদ আকন বলেন, শরণখোলার রেঞ্জে সামান্য ব্যবধানে দুটি বাঘের মৃত্যুতে আমাদের এলাকার ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। বাঘ দুটির মৃতদেহ একইভাবে খালের চরে পাওয়া গেছে। বার্ধক্যজনিত না তার বাইরে অন্য কোনো কারণ আছে? তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার পাশাপাশি বনের ওপর ব্যাপক তদন্ত করে দেখার দাবি জানাই।
পূর্ব বনবিভাগের শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে বাঘটির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। খাল পার হতে গিয়ে অথবা খাবার শিকারের জন্য নদীর চরে আটকা পড়ে বাঘটি মারা যেতে পারে। বাঘটির পোস্টমর্টেম করার পর শরণখোলা স্টেশন অফিস চত্বরে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। সাড়ে পাঁচ মাস আগে উদ্ধার হওয়া বাঘটিও ওই একই স্থানে মাটিচাপা দেওয়া হয়। ফরেনসিক টেস্টের জন্য মৃত বাঘের বিভিন্ন আলাতম সংগ্রহ করা হয়েছে।
ময়না তদন্ত সম্পন্নকারী প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. জিএম আব্দুল কুদ্দুস বাগেরহাট২৪কে বলেন, বাঘের সম্পূর্ণ দেহের মাত্র সাড়ে তিন ফুট পাওয়া গেছে। দেহের গঠনে মনে হয়েছে বাঘটি মাদী। এর মাড়ির নিচের অংশের দাঁত বেশিরভাগ ক্ষয় হয়ে গেছে। সামনের শিকারী দাঁতের একটি ভাঙা একটি নড়বড়ে। বাঘটির উচ্চতা তিন ফুট, ব্যাসার্ধ তিন ফুট তিন ইঞ্চি। পূর্ণাঙ্গ বাঘটি সাত থেকে আট ফুট লম্বা হতে পারে।
তিনি জানান, ফরেনসিক টেস্টের জন্য বাঘটির হৃৎপিন্ড, ফুসফুস ও প্লীহা সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে লিভার ও পাকস্থলী পাওয়ার যায়নি। বার্ধক্যজনিত কারণে খাবার শিকারে অক্ষমতায় দুর্বল হয়ে বাঘটি মারা যেতে পারে। প্রায় চার দিন আগে এটি মারা গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে ওয়াইল্ড লাইফের খুলনাঞ্চলের ডিএফও মো. মদিনুল আহসান বাগেরহাট২৪কে বলেন, বাঘ সাধারণত ১৪ থেকে ১৮ বছর বাঁচে। মৃত্যু একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। ২০১৯ সালের ২০ আগষ্ট যে বাঘটির মৃত্যুদেহ পাওয়া গিয়েছিল, সেটিরও মৃত্যুও বার্ধক্যজনিত কারণে হয়েছে বলে ফরেনসিক রিপোর্টে এসেছে। তবে সুন্দরবনে আগের তুলনায় বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বাগেরহাট২৪কে বলেন, বাঘের সংগ্রহিত নমুনা বন বিভাগের ওয়াইল্ড লাইফ ক্রাইম কন্ট্রোল ইউনিটের ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে। এঘটনায় শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীনকে প্রধান করে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটিকে সরেজমিন পরিদর্শন করে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
Discussion about this post