কামরুল হাসান, টাঙ্গাইল প্রতিনিধিঃ অননুমোদিত লেকভিউ প্রকল্পের নাম ভাঙিয়ে দেদারসে চলছে মাটি বিক্রির ব্যবসা। অবৈধ ড্রেজারে মাটি উত্তোলন আর বিক্রির ফলে তিন ফসলী জমি নষ্ট হওয়াসহ বর্ষা মৌসুমে দেখা দিয়েছে এলাকায় ভাঙনের শঙ্কা। আওয়ামীলীগ ও বিএনপির প্রভাবশালী নেতাকর্মীদের এক আত্মা হয়ে পরিচালিত ওই মাটির ব্যবসায় জিম্মি হয়ে পরেছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।
এরপরও মাটি ব্যবসায়িদের বিরুদ্ধে রয়েছে প্রতিবাদকারীদের মারধরসহ হুমকি ধামকির নানা অভিযোগ। প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ না থাকায় এলাকায় মাটি কাটার নৈরাজ্য চালাচ্ছেন ওই মাটি ব্যবসায়িরা। প্রাণ হারানোর শঙ্কায় জমি হারিয়েও নীরব গ্রামের সাধারণ মানুষ।
তবে বিভিন্ন দামে জমিগুলো কিনে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাদল এন্টারপ্রাইজ কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিন ফসলী জমির মাটির কাটার ওই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দেখা গেছে টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাশিল ইউনিয়নের সায়ের ও নাকাছিম এলাকায়।
বাদল এন্টারপ্রাইজের নামে লেকভিউ প্রকল্প আর মাটি উত্তোলনের কাজটি পরিচালিত হচ্ছে। কাজের অংশীদার বাদল এন্টারপ্রাইজের সত্ত¡াধিকারী ও বাসাইল উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান আর উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি কাজী শহিদুল ইসলাম এর ভাই কাজী বাদল, উপজেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও কাশিল ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাজমুল হুদা খান বাহাদুর ও উপজেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব পালনে রয়েছেন উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক আতিকুর রহমান আতিক। আওয়ামীলীগ ও বিএনপির সহযোগি সংগঠণের নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা এ কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলেও স্থানীয়দের মাঝে গুঞ্জন রয়েছে।
অভিযোগে জানা গেছে, তথা কথিত লেক ভিউ এর নামে কাশিল ইউনিয়নের নাকাছিম ও সায়ের মৌজার শতাধিক একর তিন ফসলি জমির মাটি ২০-৩০ ফুট গভীর করে কেটে বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করা হচ্ছে। দিনরাত মিলিয়ে চলছে প্রায় পাঁচ শতাধিক ড্রাম ট্রাক। মাটিবাহী ২৫-৩০ টনের ওই ড্রাম ট্রাকের চাকায় নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। পাল্লা দিয়ে গাড়ী চলাচলের ফলে বসবাসের অনুপযোগি হয়ে উঠেছে গ্রাম গুলো। অপরিকল্পিতভাবে ওই মাটি কাটার ফলে ভাঙন ঝুঁকিতে রয়েছে পার্শ^বর্তী বাঘিল গ্রামের মসজিদ আর কবরস্থান। আবাদী জমি নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি মসজিদ, কবরস্থান ভাঙনের শঙ্কায় থাকার পরও প্রাণ ভয়ে প্রতিবাদ করতে সাহস পাচ্ছেন গ্রামগুলোর সাধারণ মানুষ। ধুলা বালুতে সড়ক চলাচলে অযোগ্য হয়ে পরেছে। এরপরও সেই সড়কেই চলাচল করছে স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীসহ এলাকার বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ।
ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, অনুমতি ছাড়া আর জোর করে আমার ১৬ শতাংশ জমি কেটে নিয়েছেন বালু ব্যবসায়িরা। এভাবে আমাদের প্রায় ৭ পাকি জমি কাটা হয়েছে। ঈদের আগের দিন জমি দাম বাবদ আমাকে ২ লাখ টাকা দিয়েছেন কাজী বাদল। যদিও আমি প্রতি শতাংশ জমির দাম চেয়েছি ৪০ হাজার টাকা। দাম অনুযায়ি আমার পাওনা ৬ লাখ ৪০ হাজার টাকা। কিন্তু তারা নির্ধারণ করেছেন প্রতি শতাংশ ২২ হাজার টাকা। তাদের হিসেব অনুযায়ি এখনও ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা বকেয়া রয়েছে আমার।
তিনি বলেন, আমার জমি গুলো তিন সফলী। জমিটুকুতে আমি ধান আবাদ করতাম। নাকাছিম গ্রামের বাঙ্গি জেলার মধ্যে সেরা। এ গ্রামের জমিগুলোতে ধান, সরিষা, কাঁচামরিচসহ বিভিন্ন ধরণের সবজি আবাদ করা হত। এবছর আবাদ না হওয়ায় এ উপজেলায় সবজি ঘারতি দেখা দিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জমি কিনতে দালাল নিযুক্ত করেছেন কাজী বাদল। দালাল কোনটি কার জমি সেটি খুজে খুজে বের করাসহ বিক্রির ব্যবস্থা করছেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করেননা বলেও জানান তিনি।
ভুক্তভোগী মো. ইউনুস মিয়া বলেন, শুনে আসছিলাম এখানে লেকভিউ নামে একটি বিনোদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। এটি শুনেই শুরুতে অনেকেই জমি বিক্রি করেছেন। এখন দেখছি শুধু মাটি খনন আর বিক্রি করা হচ্ছে। প্রথমে দশ পনের ফুট বেকু দিয়ে জমি কাটলেও এখন মাটি খননের জন্য ড্রেজার ব্যবহার করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ ফুট গভীর থেকে মাটি উত্তোলন করা হচ্ছে। ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলনের প্রভাব ইতোমধ্যেই পরতে শুরু করছে। ইতোমধ্যেই পাশের জমি ভাঙতে শুরু করেছে। এ গ্রামের মসজিদ, কবরস্থানসহ আবাদী জমি ভাঙনের শঙ্কা পরেছে। লেকভিউ করতে এত মাটি খননের প্রয়োজন কেন ? এমন প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। খননকৃত জমিগুলো তিনি ফসলী জমি বলেও জানান তিনি।
দেলখুশ মিয়া বলেন, ধান, সরিষা ছাড়াও রসুন, করলা, সজ, কুমড়া, বাঙ্গিসহ নানা ধরণের শষ্য আবাদ হয় এই গ্রাম গুলোতে। নাকাছিম গ্রামের এক পাকি জমিতে আবাদ করে সারা বছর নিশ্চিতে খেতে পারেন কৃষকরা। গ্রামগুলোর প্রতিটি জমিই তিন ফসলী। মাটি ব্যবসায়ি ওই জমি গুলো কেটে বালু বের করে ফেলেছেন।
ইউনিয়নের বাঘিল নয়াপাড়া গ্রামের মনিরুল ইসলাম বলেন, এমন এক ড্রেজার তারা মাটি উত্তোলনে ব্যবহার করছে, ওই ড্রেজারে ত্রিশ ফুট গভীর থেকে বালু উত্তোলনের কারণে পাশর্^বর্তী ২০০ থেকে তার অধিক দুরত্বের জমি ধসে পরছে। কিছু টাকা দিয়ে আবার টাকা না দিয়েই ওই জমি গুলো কাটা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
পার্টনারের কথা অস্বীকার করেছেন উপজেলা কৃষকলীগের সহ-সভাপতি জহির আহমেদ পিন্টু। তিনি বলেন, আমরা কয়েকজন এখানে চাকুরী করি। লেকভিউ প্রকল্পের মালিক বাদল এন্টারপ্রাইজের সত্ত¡াধিকারী কাজী বাদল।
লেকভিউ প্রকল্পের এখনও অনুমোদন হয়নি বলে স্বীকার করেছেন বাদল এন্টারপ্রাইজের সত্ত¡াধিকারী কাজী বাদল। তিনি বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের কাজ চলছে। ক্রয়কৃত জমির মাটিই খনন করছেন তারা। জোরপূর্বক কারো জমি নেয়া হয়নি। এছাড়াও প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করতে কাউকে কোন ভয়ভীতি দেখানো হয়নি বলেও জানান তিনি।
বাসাইল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শাহজাহান মিয়া বলেন, মাটি উত্তোলনে ব্যবহৃত জমি গুলো দুই বা এক ফসলী। জমি বিক্রি বা শ্রেণী পরিবর্তনের বিষয়গুলো আমাদের না। এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেবেন উপজেলা প্রশাসন বলে জানান তিনি।
বাসাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পাপিয়া আক্তার বলেন, লেকভিউ প্রকল্পের নামে জেলা প্রশাসন বরাবর তারা একটি আবেদন করেছেন বলে আমি জানি। অনুমোদন ছাড়া তারা কিভাবে মাটি উত্তোলন করছেন সে ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মহাদয় ব্রিফ করবেন বলে জানান তিনি।
বাসাইল উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী অলিদ ইসলাম বলেন, আওয়ামীলীগ বিএনপি এক আত্মা হয়ে মাটি উত্তোলন ও বিক্রি কাজ করছেন। দেশের কোথাও আওয়ামীলীগ বিএনপি এক াাত্মা হতে না পারলেও এই মাটি ব্যবসায় এক আত্মা হয়েছেন উপজেলার আওয়ামীলীগ বিএনপির নেতৃবৃন্দ।
তিনি আরও বলেন, বিনা অনুমোদনেই চলছে লেকভিউ প্রকল্পের মাটি উত্তোলন কার্যক্রম। প্রকল্পের নামে কাটা হচ্ছে তিন ফসলী জমির মাটি। দফায় দফায় প্রতিবাদ করার কারণে ইতোপূর্বে অবৈধভাবে মাটি কাটার অভিযোগে ব্যবসায়িদের তিন লাখ জরিমানা করেছিলেন উপজেলা প্রশাসন। আবার শুরু হয়েছে সেই মাটি বিক্রি। প্রথমে বেকু দিয়ে মাটি বিক্রি শুরু করলেও এখন উত্তোলন করা হচ্ছে ড্রেজার দিয়ে। ড্রেজার দিয়ে মাটি উত্তোলনের ফলে এলাকায় যেমন দেখা দিয়েছে ভাঙনের শঙ্কা, অন্যদিকে মাটি বিক্রির জন্য ব্যবহৃত বড় বড় ড্রাম ট্রাকে নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ জনপদ। দ্রæত অবৈধ এই কার্যক্রম বন্ধে দেশের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন তিনি।
জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ইতোপূর্বেই অভিযান চালিয়ে জরিমানা করা হয়েছে। ব্যবসায়িরা বালু উত্তোলন বন্ধ রাখার কথা দিয়েছিল। এখন আবার অভিযোগ পাচ্ছি রীতিমত তারা বালু উত্তোলন ও বিক্রি করছে। ফসলী জমির বালু উত্তোলন বন্ধে দ্রæতই জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে চানান তিনি।
Discussion about this post