বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নারী, দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান নারী, স্পিকারও নারী। বিশ্বায়নের যুগে একটি দেশের সার্বিক উন্নতির মাপকাঠিতে অনেক বিষয়ই মূল্যায়ন করা হয়। শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, দেশের বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম ও নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পুলিশ বাহিনীতে ছিল না নারীর অংশগ্রহণ। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে আটজন নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেন। তবে তারা কাজ করতেন সাদা পোশাকে। এরপর পুলিশের পোশাকে নারী সদস্যদের নিয়োগ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। মাত্র ১১ জন নারী সদস্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে যে পথচলা শুরু সেখানে আজ পুলিশে নারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ছাড়িয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ নারী পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে।
পুলিশ সদরদফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে ক্রমেই বাড়ছে নারীর প্রাধান্য। যোগ্যতা ও সুযোগ অনুযায়ী বড় ও গুরুত্বপূর্ণ পদেও দায়িত্ব পাচ্ছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও উজ্জ্বল ভূমিকায় নারী পুলিশ সদস্যরা। পুরুষ সদস্যদের মতোই তারা সমান তালে, সমান চ্যালেঞ্জে এগিয়ে যাচ্ছেন। চ্যালেঞ্জিং পেশা পুলিশে নারীরা অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। মিলেছে স্বীকৃতিও। পুলিশকে নারীবান্ধব হিসেবে ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিও।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০২, যা বাংলাদেশ পুলিশের মোট জনবলের ৭.১০ শতাংশ।
পুলিশ সদরদফতরের তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ পুলিশের উচ্চপর্যায়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নারী পুলিশ কর্মকর্তা ২৮৬ জন। এর মধ্যে অতিরিক্ত ডিআইজি পাঁচজন, পুলিশ সুপার ৭০ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১০১ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার ১০১ জন। ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ১১৩ জন, উপপরিদর্শক (এসআই) ৮২৯ জন, সার্জেন্ট ৫৩ জন, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) এক হাজার ৩৯ জন, নায়েক ১১১ জন এবং নারী কনস্টেবল ১০ হাজার ৯৭১ জন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে প্রথম নারী সদস্য নিয়োগ শুরু হয়। প্রথমবার সাতজন নারী এসআই এবং সাতজন নারী কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে ফাতেমা বেগমের যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে উচ্চপর্যায়ে (বিসিএস) নারী নিয়োগ শুরু হয়। এখন পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। ১০.২৬ শতাংশ নারী পুলিশ ক্যাডারে কাজ করছেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ চালু করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে আটজন নারী সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নারীদের প্রবেশাধিকার আবার উন্মুক্ত হয়। সংখ্যার সঙ্গে বাড়তে থাকে নারী পুলিশের সুনাম ও সাফল্য।
পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও আগে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নারী সদস্যদের দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে ২৮ জন নারী সার্জেন্টের যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজপথে কাজ করতে শুরু করেন নারী পুলিশ সদস্যরা। বর্তমানে শুধু ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কাজ করছেন ১৭৬ নারী পুলিশ সদস্য।
নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৮ সালে চালু করা হয় ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক।’ ২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় নারী পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী পুলিশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়।
১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরাও। চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৫৬ নারী পুলিশ সদস্য জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) আমেনা বেগম এবং রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপস) সালমা বেগম, টাঙ্গাইল মহেরা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের ডেপুটি কমান্ড্যান্ট শামিমা বেগম, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রটেকশন শাখার দায়িত্ব পালন করছেন রোখফার সুলতানা এবং প্রথমবারের মতো র্যাবের কোনো একটি ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব পেয়েছেন নারী কর্মকর্তা। র্যাব-৮ এর সিও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত ডিআইজি আতিকা ইসলাম।
সিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিআইজি) ও বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্কের সভাপতি আমেনা বেগম বলেন, সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় বাড়াতে হবে নারীর অংশগ্রহণ। দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ পুলিশের জয়যাত্রা চলছে। এতে পুরুষের মতো ভূমিকা রয়েছে ১০ শতাংশের বেশি নারী পুলিশ সদস্যদেরও। পুলিশের দক্ষতা-সক্ষমতা বৃদ্ধি, নেতৃত্বের বিকাশ, মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত নারী পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যার প্রতিফলন বিভিন্ন অপারেশনাল কাজে পুরুষের মতো সমান সাফল্য পাচ্ছেন নারী কর্মকর্তারাও। সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে নারী পুলিশ সদস্যরা কর্মদক্ষতার সবটুকু প্রয়োগে বদ্ধপরিকর বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানান, পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ ও পদায়নে নারী-শিশুদের নিরাপত্তা রক্ষার কাজ সহজ হচ্ছে। নারী ও শিশুদের তাৎক্ষণিক বিপদ থেকে রক্ষায় পুলিশ অ্যাপ চালু করতে যাচ্ছে। বিপদে পড়লে মুঠোফোনের একটি বাটন চাপ দিলেই ভুক্তভোগীর আশপাশে অবস্থান করা পুলিশ তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাবে। অ্যাপটি কিছুদিনের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হচ্ছে। এছাড়া সারাদেশের থানায় নারী ও শিশু ডেস্ক চালু করা হয়েছে। জেলায় জেলায় করা হয়েছে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার।
পুলিশে নারীর অবস্থান দিনদিন শক্তিশালী হচ্ছে উল্লেখ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বর্তমান সরকার নারীর ক্ষমতায়ন, সমঅধিকার ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে। এরই অংশ হিসেবে পুলিশে নারীর সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগই প্রথম পুলিশে নারীর পদায়ন ও পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসে নারীর সুযোগ করে দিয়েছে।
তিনি বলেন, নারী সদস্যরা পুলিশিংয়ের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় অনবদ্য ভূমিকা পালন করে চলছে। নারী পুলিশ নিয়ে গঠিত পূর্ণাঙ্গ নারী আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন ও উইমেন অ্যান্ড ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে কর্মরত নারীরা কর্মক্ষেত্রে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখছেন। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারগুলো নির্যাতিত নারী ও শিশুদের একান্ত নির্ভরতা-আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। নারী সার্জেন্টরা ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সাড়া জাগিয়েছেন।
Discussion about this post