করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ইউরোপ-আমেরিকার বেশকিছু দেশে লকডাউন (অবরুদ্ধ) ঘোষণা করা হয়েছে। বাংলাদেশেও সভা-সমাবেশ, ওয়াজ-মাহফিলসহ জনসমাগম হয়- এমন যেকোনো অনুষ্ঠান বন্ধে মাঠপ্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পাশাপাশি মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।
যদি সারাদেশ অবরুদ্ধ হয় তাহলে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কীভাবে পাওয়া যাবে- এমন প্রশ্ন এখন রাজধানীবাসীসহ সারাদেশের মানুষের। সরকার বলছে, এখনও পুরো দেশে লকডাউন ঘোষণার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়নি। তবে যদি হয়েও যায় তারপরও যেকোনো মূল্যে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখবে সরকার। এজন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি রয়েছে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে নিত্যপণ্য আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২৫-৩০ শতাংশ পণ্য বেশি মজুত রয়েছে। তাই ভোক্তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য না কিনে অযথা অস্থিরতা সৃষ্টি না করার আহ্বান জানানো হচ্ছে।
এদিকে করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে কোনো অসৎ ব্যবসায়ী যাতে নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পরে সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গতকাল বুধবার (১৮ মার্চ) এ সংক্রান্ত এক চিঠি দেশের সব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চিঠিতে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি বা সংকটের কথা বলে কেউ গুজব ও অপপ্রচার চালাতে যেন না পারে সে বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ অথবা প্রয়োজনের অধিক পণ্য কিনে কেউ বা কোনো গোষ্ঠী যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পরে সেজন্য জনসচেতনতাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হলো।
লকডাউন অবস্থায় নিত্যপণ্যের সরবরাহ কীভাবে স্বাভাবিক রাখা হবে- জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, যেকোনো হরতাল-অবরোধ বা স্ট্রাইকে নিত্যপণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত গাড়ি এসবের আওতামুক্ত থাকে। লকডাউন হলেও এসব গাড়ি এর আওতামুক্ত থাকবে। অবস্থা যদি আরও খারাপ পর্যায়ে চলে যায়, সেক্ষেত্রে শেষ পর্যায়ে সরকার সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে পারে এবং সে প্রস্তুতিও সরকারের রয়েছে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন বলেন, ‘সারাদেশে লকডাউনের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নিত্যপণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখবে সরকার। তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাজারে অস্থিরতা সৃষ্টি না করার আহ্বান জানাচ্ছি।’
তিনি আরও বলেন, মুজিববর্ষ উপলক্ষে ইতোমধ্যে টিসিবি চিনি, ডাল, ভোজ্যতেল ও পেঁয়াজ বিক্রি শুরু করেছে। আসন্ন রমজানেও অন্য বছরের তুলনায় ৭-১০ গুণ পণ্য নিয়ে মাঠে থাকবে টিসিবি।
এদিকে বুধবার (১৮ মার্চ) বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করায় জনগণ আতঙ্কিত। প্রয়োজনের তুলনায় বেশি পণ্য কিনছেন তারা। তাই গত দুদিনে খুচরা বাজারে দামে কিছুটা প্রভাব পড়েছে। তবে পাইকারি বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়েনি।’
তিনি বলেন, অতিরিক্ত পণ্য কিনে বাজারে অহেতুক অস্থিরতা তৈরি করবেন না। প্রতিটি পণ্যের যথেষ্ট মজুত রয়েছে। জনগণ মনে করতে পারে সমস্যা হবে, কিন্তু আসলে কোনো সমস্যা হবে না। কারণ করোনার কারণে নিত্যপণ্য আমদানিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং অন্যান্য বছরের চেয়ে ২৫-৩০ শতাংশ মজুত বেশি রয়েছে। কাজেই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।
প্রতিটি পণ্য ২৫-৩০ শতাংশ বেশি মজুত রয়েছে। বৈশ্বিক সমস্যার পরও আমাদের সবকিছু সুদৃঢ় রয়েছে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পণ্য কেনার জন্য হঠাৎ করে বাজারে প্যানিক সৃষ্টি হয়েছে বলেও জানান টিপু মুনশি।
এদিকে নিত্যপণ্যের চাহিদা, মজুত ও বাজারদর সংক্রান্ত বুধবারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে দেশে তিন কোটি ৮৭ লাখ টন চালের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ হয়েছে। গত অর্থবছরে চালের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল তিন কোটি ৭৪ লাখ টন। এছাড়া বর্তমানে সরকারিভাবে ১৪ লাখ ৩৬ হাজার টন চালের মজুত রয়েছে।
এতে আরও বলা হয়, চালের বাজার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, এক বছর আগে যে চালের কেজি ছিল ৩৮-৪২ টাকা বর্তমানে তা ৩৪-৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
এক বছর আগে খোলা আটার কেজি ছিল ১৭-৩০ টাকা। বর্তমানে তা ২৬-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গমের আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। বিগত অর্থবছরে সর্বমোট ৪৬ লাখ ৪৮ হাজার টন গম আমদানি হয়েছে। এ বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গম আমদানি হয়েছে ৩৫ লাখ ৩১ হাজার টন এবং সরকারি পর্যায়ে মজুতের পরিমাণ তিন লাখ ২৬ হাজার টন।
১৮ লাখ ৬০ হাজার টন ভোজ্যতেলের চাহিদার বিপরীতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৮৪ হাজার টন। গত অর্থবছরে ভোজ্যতেলের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৫ লাখ ৩০ হাজার টন।
এছাড়া মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে সয়াবিনের বাজারদর ৮৮-৯২ টাকা প্রতি লিটার, যা বিগত এক মাসের তুলনায় কিছুটা বেশি। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে নিম্নমুখি প্রবণতা শুরুর কারণে কিছুদিনের মধ্যে দেশীয় বাজারদর কমবে বলে আশা করা যায়।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, চিনির বার্ষিক চাহিদা ১৮ লাখ টনের বিপরীতে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আমদানি হয়েছে ১১ লাখ এক হাজার টন। এছাড়া দেশে এ বছর প্রায় ৭০ হাজার টন চিনির উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বিগত অর্থবছরে বছরজুড়ে মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৩৩ হাজার টন। তাই এখন পর্যন্ত চিনির আমদানি পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। এছাড়া বাজারদর বিগত এক মাসে প্রায় ১.৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও আমদানি ও মজুত পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় চিনির বাজারদর স্থিতিশীল থাকবে।
এসব পণ্য বাদে মশুর ডাল, পেঁয়াজ, রসুন, লবণ ইত্যাদির বাজারদর বিগত এক মাসে হ্রাস অথবা স্থিতিশীল রয়েছে। বিগত এক মাসে মশুর ডালের বাজার দর ৬.৯০ শতাংশ, পেঁয়াজ ৪৬.৯৪ শতাংশ এবং রসুনের দর ৫২.৭৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এছাড়া লবণের বাজারদর অপরিবর্তিত রয়েছে। বর্তমানে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্যের সরবরাহ অবাধ ও স্বাভাবিক রাখতে সরকার যথাযথভাবে কাজ করছে। তাই চাহিদার তুলনায় মাত্রাতিরিক্ত পণ্য ক্রয়ের প্রয়োজন নেই।
আতঙ্কিত না হয়ে ক্রেতা হিসেবে স্বাভাবিক ক্রয় করলে কোনো ধরনের সঙ্কট তৈরি হবে না বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।
Discussion about this post