দুর্নীতির দায়ে ২ বছর ১ মাস ১৬ দিন সাজা ভোগের পর শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি পেয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। ছোট ভাই শামীম ইস্কান্দারের জিম্মায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। তবে দলের বাইরে সম্পূর্ণ পারিবারিক উদ্যোগেই কারামুক্তি মিলেছে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার।
এ জন্য কেবল খালেদা জিয়ার সম্মতি নিয়ে চলতি মাসের ২১ মার্চ শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সাক্ষাৎ করেন তার ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার, মেজ বোন সেলিমা ইসলাম ও প্রয়াত ভাই সাঈদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরীন এস্কান্দার। এসময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার প্রাণভিক্ষা স্বজনরা। এ সময় তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার মুক্তির আবেদন জানালে সেই প্রক্রিয়া দ্রুত এগিয়ে যায় বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা
২৪ মার্চ বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, মানবিক দিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে শর্ত সাপেক্ষে তাকে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। পরদিন ২৫ মার্চ বিকেলেই রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল থেকে মুক্তি পান দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।
হাসপাতাল থেকে সরাসরি গুলশানের বাসা ‘ফিরোজা’য় চলে যান তিনি। এরপর থেকে হোম কোয়ারেন্টাইনেই আছেন খালেদা জিয়া। তার ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা তার চিকিৎসা দিচ্ছেন। লন্ডন থেকে ব্যক্তিগত চিকিৎসকদের নির্দেশনা দিচ্ছেন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা খালেদা জিয়ার এক স্বজন শনিবার বলেন, ‘কারাবন্দি অবস্থায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা দেখে আমরা এতটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম যে এ অবস্থায় যেকোনোভাবে তার মুক্তি চেয়েছিলাম। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চাইলে সবুজ সংকেত পাওয়া যায়। এরপরই খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই কর্মকর্তা বলেন, স্বজনরা তার শারীরিক অবস্থার বর্ণনা করে যেকোনো উপায়ে খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে বলেন। আইন-আদালত করতে গেলে মুক্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেবে। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার কথা চিন্তা করে আমরা সে পথে যেতে চাই না। শেখ হাসিনাকে তারা আরও বলেন, তাই দ্রুত মুক্তির জন্য আমরা আপনার শরণাপন্ন হয়েছি।
জবাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের আশ^স্ত করেন খালেদার মুক্তির ব্যাপারে। খালেদা জিয়া এ ব্যাপারে অবগত কি না, স্বজনদের কাছে জানতে চান শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী খালেদার স্বজনদের কাছে আরও জানতে চান, মুক্তির নিয়মকানুন পালন করেছেন কি না? তারা বলেন, তা করেছি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী খালেদার স্বজনদের বলেন, আমি প্রতিহিংসার রাজনীতি করি না। বিএনপির শাসনামলের বিভিন্ন নেতিবাচক রাজনীতির বর্ণনা করেন শেখ হাসিনা। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী খালেদার স্বজনদের কথা মনোযোগসহকারে শোনেন এবং মানবিক দিক বিচার করে দ্রুত মুক্তির সিদ্ধান্ত জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে।
খালেদা জিয়ার হঠাৎ মুক্তির প্রক্রিয়া নিয়ে আওয়ামী লীগের ভেতরেও অনেক চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। তাদের দাবি, মুক্তি দেওয়া হবে বিষয়টি দলীয়ভাবে জানা থাকলে তাদেরও ‘ডিফেন্ড’ করার সুযোগ থাকত। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আরেক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, একেবারে মানবিক মূল্যবোধ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সিদ্ধান্ত নেন বিধায় তেমন জানাজানি না করে দ্রুত খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, এ সময় রাজনৈতিক দিক একেবারেই বিবেচনায় নেননি প্রধানমন্ত্রী।
খালেদা জিয়ার হঠাৎ মুক্তি নিয়ে বিএনপি নেতাদের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ আছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘স্বজনরা যে প্রক্রিয়ায় চেয়ারপারসনকে মুক্ত করলেন, তা যথাযথ হয়নি। এভাবে নতি স্বীকার করে চেয়ারপারসনকে মুক্ত করা ঠিক হয়নি। এভাবে মুক্তির ফলে দলের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ হবে। চেয়ারপারসনের যে আপসহীন ইমেজ তা আর রইল না। খালেদা জিয়ার স্বজনরা যে উদ্যোগ নিয়েছেন তাতে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সায় ছিল না।’
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বিএনপি চেয়ারপারসনের ওই স্বজন বলেন, ‘কারাবন্দি অবস্থায় খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার যে চরম অবনতি হয়েছিল তা নিয়ে শঙ্কিত ছিলাম আমরা। যেকোনো মূল্যে তার মুক্তির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য যোগাযোগ করা হলে সবুজ সংকেত পাই। তার দেওয়া সময়ে গণভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করি।
প্রধানমন্ত্রী সব শুনে খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে আইনমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন। খুবই গোপনে এ কাজ হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকেও বিষয়টি গোপন রাখা হয়েছিল। যার কারণে কোনো রকম আগাম সংকেত ছাড়াই কেউ টের পাওয়ার আগেই চেয়ারপারসনের মুক্তির উদ্যোগ নেওয়া হয়।’ তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কাছে খালেদা জিয়ার প্রাণভিক্ষা চাওয়া হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী তাতে সাড়া দিয়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি দিয়েছেন।’
চিকিৎসা চলছে হোম কোরারেন্টাইনে : বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, হোম কোয়ারেন্টাইনের মধ্যেই দলের চিকিৎসকরা চেয়ারপারসনের চিকিৎসা দিচ্ছেন। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘লন্ডনে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানের নির্দেশে চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা চিকিৎসা দিচ্ছেন। বিএসএমএমইউ হাসপাতাল কর্র্তৃপক্ষের মেডিকেল বোর্ড যে চিকিৎসা দিয়েছিল বলতে গেলে সেভাবেই তার চিকিৎসা চলছে।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের হৃদরোগ বিভাগের চিকিৎসক ও খালেদা জিয়ার স্বজন ডা. মামুন চিকিৎসা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত রয়েছেন।’ তিনি জানান, বিএনপি চেয়ারপারসনের চিকিৎসায় দলের পক্ষ থেকে যে বোর্ড গঠন করা হয়েছে তারা নিয়মিত চেকআপ করছেন। গত বুধবার তাকে দেখে গেছেন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এফ এফ সিদ্দিকুর রহমান, অধ্যাপক ডা. রাজিবুল আলম, অধ্যাপক ডা. আবদুল কুদ্দুস, অধ্যাপক ডা. হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক ডা. জাহিদ হোসেন ও ডা. মামুন।
কেমন কাটছে খালেদা জিয়ার দিনকাল জানতে চাইলে তার মেজ বোন সেলিমা ইসলাম বলেন, ‘নিজ বাসায় কোয়ারান্টাইনে থাকলেও স্কাইপেতে ছেলে, দুই পুত্রবধূ ও নাতনিদের সঙ্গে কথা বলছেন। কাছে আছেন ভাই-বোনরা। অনেক দিন পরে পরিবারের সান্নিধ্যে হাসি-খুশি সময় পার করছেন বিএনপি চেয়ারপাসন খালেদা জিয়া। শারীরিকভাবে অসুস্থ হলেও মানসিকভাবে ভালো আছেন তিনি। আপাতত কোনো নেতাকর্মীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না। ফলমূল ছাড়া বাইরের কোনো খাবার তিনি খাচ্ছেন না। জ্যেষ্ঠ নেতারা মুঠোফোনে খোঁজ রাখছেন।সূত্র: দেশ রূপান্তর।
প্রসঙ্গত, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের কারাগারে পাঠানো হয় খালেদা জিয়াকে। ওই বছরের ১ এপ্রিল খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য গঠিত বিশেষ মেডিক্যাল বোর্ড কারাগারে গিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে। এরপর ৭ এপ্রিল বেলা ১১টা ২০ মিনিটে নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নেওয়া হয়।
চূড়ান্তভাবে ২০১৯ সালের ১ এপ্রিল দুপুর ১২টা ২০ মিনিটের দিকে পুরান ঢাকার নাজিম উদ্দিন কারাগার থেকে বিএসএমএমইউতে ভর্তি করানো হয় তাকে। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রথমে পাঁচ বছরের এবং পরবর্তী সময়ে তা বাড়িয়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন আদালত। অন্যদিকে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ৭ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে তার। এই দুই মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মোট ১৭ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।” কপি ”পূর্বপশ্চিমবিডি/জিএম”
Discussion about this post