বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের পর শুক্রবার পর্যন্ত দুই মাসে আক্রান্তের সংখ্যা ১৩হাজার ছাড়িয়েছে।
রাজধানী ঢাকাতেই এপর্যন্ত সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এর সাথে নারায়ণগঞ্জ-গাজীপুরসহ ৮টি জেলায় সংক্রমণ বেশি হওয়ায় এগুলোকে হটস্পট বলা হচ্ছে।
কেন এই এলাকাগুলোতে সংক্রমণ বেশি হয়েছে এবং আক্রান্তদের আর্থ-সামাজিক অবস্থান এ ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রেখেছে কি না-এসব প্রশ্নে নানা আলোচনা চলছে।
রাজধানীতে প্রথম রোগী শনাক্ত হয় মিরপুরের টোলারবাগ এলাকায়।এখন মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মহাখালী, রাজারবাগ, যাত্রাবাড়ী এবং পুরোনো ঢাকায় সংক্রমণ বাড়ছে এবং এই এলাকাগুলোকে হটস্পট বলা হচ্ছে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের সংক্রামক রোগ কর্মসূচির সহযোগী পরিচালক ডা: মাহফুজা রিফাত বলেছেন, ঢাকায় ঘনবসতির এলাকাগুলোতে ভাইরাস বেশি ছড়িয়েছে। এটিই মূল কারণ বলে তিনি মনে করেন।
“সামাজিক দূরত্বের কথা বলি আর লকডাউনের কথা বলি-এগুলো মানা হচ্ছে কি না-ঘনবসতির এলাকাগুলোতে, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন। এসব এলাকায় মানুষ বাড়িতে যেভাবে বসবাস করে, সেটাও দেখতে হবে। এছাড়া ঢাকায় টেস্ট বেশি হচ্ছে।”
ঢাকার পরই নারায়ণগঞ্জে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। এই জেলা থেকেই দেশের অনেক এলাকায় ছড়িয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ বলেছে।
নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা: মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বলেছেন, সেখানে আক্রান্তদের সামাজিক অবস্থান খতিয়ে দেখলে ধনী গরিব বা শ্রমিকের মধ্যে পার্থক্য করা যাচ্ছে না। আক্রান্তদের মধ্যে সব শ্রেণীর মানুষ রয়েছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন।
“নারায়ণগঞ্জে মোটামুটি সব শ্রেণীর মানুষই আক্রান্ত হয়েছেন। যেমন র্যাবের ৮২ জন, পুলিশের আক্রান্ত হয়েছেন ৭০ থেকে ৮০জন। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী ৮২জন আক্রান্ত হয়েছেন। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নআয়ের সব ধরণের মানুষই আক্রান্ত হয়েছেন।”
নারায়ণগঞ্জ হটস্পট হওয়ার পিছনে তিনটি কারণ উল্লেখ করেছেন ডা: ইমতিয়াজ।
তিনি বলেছেন, “প্রথমত নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জনঘনত্বপূর্ণ এলাকা। দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, মার্চের এক তারিখ থেকে বিমানবন্দর বন্ধ হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন এক হাজারের বেশি প্রবাসী নারায়ণগঞ্জে এসেছেন। আর তৃতীয় কারণ হচ্ছে,বাংলাদেশে প্রথম যে রোগী শনাক্ত হয়, সেই ব্যক্তি নারায়ণগঞ্জের অধিবাসী এবং ইতালি প্রবাসী।
”উনি শনাক্ত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে দেশে আসেন। এক সপ্তাহ যাবৎ উনি কিন্তু শপিংমল, শ্বশুরবাড়ি, চায়ের দোকানসহ অনেক জায়গায় ঘুরেছেন।এই কয়েকটি কারণ রয়েছে বলে আমার মনে হয়,” জানান ডা: ইমতিয়াজ।
গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, কুমিল্লা এবং ময়মনসিংহকেও হটস্পট হিসাবে দেখা হচ্ছে।
যদিও এসব এলাকায় আক্রান্ত বেড়ে যাওয়া কারণ বা আক্রান্তদের আর্থ-সামাজিক অবস্থানের বিষয়গুলো নিয়ে আইডিসিআর সহ সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান এখনও গবেষণা করেনি।
আইইডিসিআর এবিষয়ে এখন গবেষণা করবে বলে সরকারি সূত্রগুলো বলছে।
তবে আইডিসিআর এর কর্মকর্তারা বলেছেন, শুরু থেকে পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে তারা দেখেছেন, প্রথমে ইতালি থেকে আসা প্রবাসীদের কাছ থেকে এই সংক্রমণ শুরু হয়েছিল।
এরপর বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের অনেকে বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় সংক্রমণ হয়েছে।
এর পরের পর্যায়ে এলাকাভিত্তিক সংক্রমণ পাওয়া যায়। সেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় কমিউনিটিতে ছড়িয়েছে এবং এখন বিস্তার ঘটছে।
আইইডিসিআর এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড: এস এম আলমগীর বলেছেন, নিম্ন আয় বা বিশেষ কোনো গোষ্ঠী নয়, সব শ্রেণীর মানুষই আক্রান্ত হচ্ছেন।
”
শ্রেণী বিন্যাসে আমাদের এখানে একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার আছে। আমরাতো প্রথমদিকে একেবার সবার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করেছিলাম। সেই কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করতে গিয়ে আমরা দেখলাম, আমরা যতজনের কন্ট্যাক্ট খুঁজে পেতাম, তার কোনো কোনো ক্ষেত্রে একশোর কাছাকাছি কন্ট্যাক্টর ছিল আমাদের একেক জন রোগীর।”
“আমরা সবার নমুনা সংগ্রহ করতাম। তা করে আমরা দেখতাম যে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখার পুরো সময়টা তাদের কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। কিন্তু তারা পজেটিভ।”
ড: আলমগীর আরও বলেছেন, “আর্থ-সামাজিক অবস্থার কথা চিন্তা করলে আসলে এখানে সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ আছে। কিন্তু বয়েস বিবেচনায় নিলে তা খুবই ব্যতিক্রমী যে ২০ থেকে ৫০বছর বয়সের এর ভিতরের মানুষই এখনও আক্রান্তদের অধিকাংশ।”
তবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ঢাকার টোলারবাগ এবং মাদারিপুরের শিবচরে শুরুতেই কঠোর লকডাউনের কারণে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। লকডাউন এবং স্বাস্থ্য বিধি না মানার কারণেই বিভিন্ন এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
“টোলারবাগে দেখা গেলো যে কমন একটা সোর্স একটা মসজিদ থেকে প্রথমদিকে ছড়াচ্ছিল। বাসাবোতেও একই বিষয় ছিল। তখন আমরা এই দু’টা এলাকায় লকডাউন করেছি এবং সাথে সাথে আমরা মাদারিপুরের শিবচরও লকডাউন করেছিলাম। ক্লাস্টার হিসাবে ঘোষণা করে লকডাউন করে দেয়ায় আমরা এই জায়গাগুলো নিয়ন্ত্রণে আনতে পেরেছিলাম।”
আইডিসিআর এর কর্মকর্তা ড: আলমগীর মনে করেন, এখনও বাংলাদেশের অনেক এলাকায় আক্রান্তের সংখ্যা কম আছে এবং সেই এলাকাগুলোতে নতুন কোনো রোগী না ঢুকলে সংক্রমণ সেখানেই শেষ করা সম্ভব।
Discussion about this post