করোনাভাইরাসের কারণে সরকারী সাধারণ ছুটি ঘোষণা থাকায় দীর্ঘ দুই মাস পর বন্দরনগরীতে চলাচল শুরু করেছে গণপরিবহন।
ঘোষণা দিয়ে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ালেও মানা হচ্ছে না শারীরিক দূরত্ব বা স্বাস্থ্যবিধি। স্বাস্থ্যবিধি মানার নির্দেশনা থাকলেও তা মানার কোনো দৃশ্যমান কোনো কিছু দেখা যায়নি।
রাস্তায় চলাচলরত বাস বা স্টাফ বাসে ছিল না হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশকের মতো কোনো সুরক্ষা সামগ্রী। শুধুমাত্র কয়েক সড়কে সিটের দূরত্ব বজায় রাখলেও আর কোনও স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। অন্যদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো মনস্তত্ত্ব ও পরিবেশ আমাদের এখানে নেই। সুতরাং আমরা
আরো বড় রকমের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছি।
এমনিতেই গণপরিবহন সংকটের কারণে নাজুক চট্টগ্রাম নগরীর ট্রাফিক ব্যাবস্থাপনার চিত্র। তার উপর ‘অর্ধেক যাত্রী’ পরিবহনের নির্দেশনা যেন সড়কের নতুন বিষফোঁড়া! সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ধরণের সিদ্ধান্ত সময় উপযোগী কিন্তু নগরীর জর্জরিত ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার কারণে এসব সিদ্ধান্ত মেনে চলা সম্ভব নয়। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বরঞ্চ সৃষ্টি হবে গণরোষ।
এদিকে স্বাস্থ্য বিধির প্রথমেই বলা হয়েছে, পাশাপাশি দুইটি আসনের একটিতে যাত্রী বসে অন্যটি ফাঁকা রাখতে হবে। কিন্তু কোনো আসন ফাঁকা না রেখেই শুধুমাত্র ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মানার চেষ্টা করছে গণপরিবহনে। নিরাপদ দূরত্ব না মেনে শুধু ব্লিচিং পাউডার ছিটানো ও মাস্ক ব্যবহার করায় সংক্রমণ ঝুঁকি বাড়ছে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
শেয় স্বাস্থ্যবিধি কীভাবে মানা হচ্ছে তা দেখার জন্য সিটিনিউজ টিভির প্রতিবেদক সিটি গেইট এলাকা থেকে অলংকার মোড় হয়ে দেওয়ান হাট ও দেওয়ান হাট থেকে জিইসি হয়ে একে খান মোড় সরেজমিনে পরিদর্শন করেন। অন্যদিকে সিটিনিউজ টিভি আরও তিন প্রতিবেদক নগরীর গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক মোড় সরেজমিন পরিদর্শন করেন।
পরিদর্শনে দেখা যায়, বাসে আসন সংখ্যা বরাবর যাত্রী নেয়া হচ্ছে। বাসে প্রবেশের সময়ে পানিতে মেশানো ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে জীবাণুমুক্ত থাকার চেষ্টা করছেন। রাস্তায় বাসের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকটাই কম হলেও সিএনজি ও টেম্পু চলাচল প্রায় স্বাভাবিক হয়েছে।
কিছু কিছু সিএনজি’ও গণপরিবহনের মতো ব্যবহৃত হচ্ছে। সব পরিবহনেই নিরাপদ দূরত্বের কোনো বালাই মানা হচ্ছে না। এছাড়া যাত্রীদের সবাই মুখে মাস্ক রেখেছেন। তারমধ্যে কেউ কেউ মুখের মাস্ক চিবুকে আটকে রেখে নাক-মুখ খোলা রেখেছেন।
বাসে চড়ে জিইসি থেকে একেখান মোড়ে যাওয়া একজন যাত্রীকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘কাজ কর্পোরেট অফিসে করলেও বেতন পাই সরকারি অফিসের পিয়নের সমান। এ অল্প টাকা পেয়ে রিজার্ভ সিএনজি নিয়ে অফিসে যাতায়াত করা সম্ভব না। যা হবে, তা দেখা যাবে। করোনার জন্য হাত গুটিয়ে বসে থাকলে পেটের খিদায় মারা যাবো।’
সেলিম নামে চার নাম্বার রুটের একজন চালককে গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘করোনা যে হারে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে, এটা দেখে আমাদের সাবধান হওয়া দরকার।
আমরা যদি সাবধান না হই, নিজেরাই মারা যাবো। আর নিজের মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর হলো পরিবারের অন্য কারো মৃত্যু। আমি এখন বাড়ি পাশের একটি খামারে কাজ করছি। করোনা চলে গেলে তারপর আমি গাড়ি নিয়ে বের হবো।’
মঙ্গলবার সকালে নগরীর চকবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় বড় কোনো বাস নেই। আছে শুধু মিনি বাস ও টেম্পো। যেগুলোর কোনোটিতেই হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা জীবাণুনাশক সামগ্রী ছিল না। তবে ড্রাইবার- হেলপার ও যাত্রীরা সবাই মাস্ক পড়েছেন।
মহসিন নামের এক যাত্রী বলেন, তিনি নিউমার্কেট থেকে বহদ্দারহাট যাচ্ছেন। বাসের ভেতর তেমন চাপ নেই। তবে তিনি বাসে কোনো হ্যান্ড স্যানিটাইজার দেখেননি। হ্যান্ড স্যানিটাইজারসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সামগ্রী থাকলে ভাল হতো।
ইপিজেডএ এলাকায়ও কিছু গণপরিবহনে শুধু শারীরিক দূরত্বে বসার মাধ্যমেই স্বাস্থ্যবিধি সীমাবদ্ধ ছিল। বেশিরভাগ গণপরিবহনের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই ছিলো না।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্দরনগরীর কাঠগড় এলাকায় গার্মেন্টস এর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্টাফ বাসের অধিকাংশেই ছিল না শারীরিক দূরত্ব। আগের মতই গাদাগাদি করে বাসের ভেতর যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে। গাড়ির প্রবেশ মুখে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও জীবাণুনাশক রাখার কথা থাকলেও তা দেখা যায়নি।
এতে করে অনেকেই নানান ক্ষোভ প্রকাশ করতেও দেখা গেছে। অনেকেই জানিয়েছেন, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে গণপরিবহনে চলাচলের নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছেনা। গাড়ির প্রতিটি আসনে এমনকি ড্রাইভারের পাশে থাকা মেশিনের উপর বসেও যাত্রী চলাচল করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে গণপরিবহনগুলোর অবস্থা আরো করুন। স্বাস্থ্য বিধি মানবে দূরের কথা কার আগে কে গাড়িতে উঠবে সেই প্রতিযোগিতা ছিল যাত্রীদের। তাছাড়া গাড়ির ড্রাইভার ও হেলপারের মাঝেও স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি ছিল উপেক্ষায়। কিছু কিছু গাড়ী চালকের মুখে মাস্ক পর্যন্ত দেখা যায়নি। কিছু গাড়ি ব্যতিক্রম থাকলেও তাতে শুধু আসন ফাঁকা ছাড়া অন্য স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি।
ক্যানপার্কে গার্মেন্টস কর্মী আসাদ জামান সিটিনিউজ টিভিকে বলেন, বাসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না কেউ। শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা হচ্ছে না।জীবাণুনাশক স্পেও করা হচ্ছে না। স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব এখন শুধু কথা আর কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ। এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে কি ঘটবে তা বলা মুশকিল। তবে স্বাস্থ্য সচেতনতার বিষয়টি সবাইকে মেনে চলা উচিত।
বাস শ্রমিক আজাদ তালুকদার বলেন, ‘সীমিত পরিসরে হলেও সরকার গণপরিবহন চালু করেছে। এতে আমরা খুশি। আয় বেশি না হলেও খেয়ে তো বাঁচতে পারব। আরেক শ্রমিক হাসান মিয়া বলেন, সরকার যে নির্দেশনা দিয়েছে তা মেনেই বাস চালানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে যাত্রীদের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বলেন, আজকে প্রায় ৬৬ দিন পরে ৭০ ভাগ গণপরিবহন সড়কে নেমেছে। কাউন্টার সার্ভিসে শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে। লোকাল সার্ভিসের ক্ষেত্রে কিছু কিছু যাত্রী, চালক ও সহকারীর অসচেতনতা মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে। যদিও প্রশাসন কঠোরভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার বিষয়টি তদারকি করছেন।
গণপরিবহন মালিক সমিতির সূত্র মতে, নগরে ১ হাজার ১৫০ থেকে ১২শ বাস, দেড় হাজার হিউম্যান হলার ও ১ হাজার ৭০০ টেম্পু চলাচল করে। আজকে যারা রাস্তায় নামেনি, তাদের কেউ কেউ গাড়ির কাজ করিয়ে নিচ্ছেন, কেউ কেউ জীবনের প্রতি মায়া রেখে গণপরিবহন নিয়ে নামচ্ছেন না।
আইইসিডিআরের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘সারাবিশ্বের মতো আমাদেরও আজকে নতুবা কালকে সবকিছুই খুলতে হতে পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে জন সমাগম যেন না হয় সেদিকে দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। অথচ এখনই সব খুলে দেয়া হয়েছে। এখন পরীক্ষামূলক কিছু করার সময় নয়। আমাদের বুঝতে হবে, আক্রান্ত সংখ্যা বাড়ানোর মতো কিছু করার আগে আমাদের টেস্টের পরিমাণ বাড়ানো প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার মতো মনস্তত্ত্ব ও পরিবেশ আমাদের এখানে নেই। সুতরাং আমরা আরো বড় রকমের ঝুঁকির দিকে এগুচ্ছি।’
চসিকের কাউন্সিলর জিয়াউল হক সুমন সিটিনিউজ টিভিকে কে বলেন, ‘যাত্রীরা যারা আছেন তাদেরও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। গাড়িতে কী সুবিধা ভোগ করবেন, কোনটা স্বাস্থ্যবিধির লঙ্ঘন সেটাও যাত্রীদের জানা জরুরি।’
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সিএমপির জুড়ে দেওয়া ১৬ নির্দেশনা বাস্তবায়ন করার কাজ ‘কিছুটা’ কঠিন হলেও সম্ভব। কিন্তু সড়কের বাস্তব চিত্র বলছে, করোনা মোকাবেলার এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা করছেন না গণপরিবহনের চালকরা। সেই সাথে নিজেকে অতিরিক্ত হিসেবে ধরে নিয়ে বাসে গাদাগাদি করে ঝুলছে যাত্রীরা।
সব মিলিয়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মানার নাম নেই সড়কে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে অল্প কয়েক দিনে করোনা বিষের বিষ্ফোরক হয়ে উঠবে অনিয়মে চলা সড়কের এসব যাত্রী-চালক।
সূত্রমতে, ৬০ লাখ মানুষের বন্দর নগরীতে গণ পরিবহনের সংখ্যা সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার। অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সংস্থা বলছে, স্বাভাবিক অবস্থায় এই নগরীতে এসব গণ পরিবহন ব্যবহার করার জন্য প্রতিদিন নগরীতে নেমে আসেন ২৫ থেকে ৩০ লাখ যাত্রী। সহজ সমীকরণে বলা চলে, গণ পরিবহনের প্রতি সিটের বিপরীতে আছেন কমপক্ষে ৯ থেকে ১১ জন যাত্রী। তবে বর্তমান করোনা কাণ্ডে স্কুল-কলেজগুলো এখনো পর্যন্ত বন্ধ থাকার কারণে এই চাপ কিছুটা কম।
সড়কের এমন নাজুক অবস্থায় করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ‘অর্ধেক যাত্রী’ নেওয়ার নির্দেশনা বাস্তবে কতটুকু কার্যকর সম্ভব? এমন প্রশ্নের উত্তরে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মোটেও সম্ভব নয়। এই পরিস্তিতি বড়জোড় ২/৪ দিন পর সব আগের মত লেজে গোবরে হয়ে যাবে।’
অবশ্য অবস্থা লেজে গোবরে হতে ২/৪ দিন সময় লাগে নি। সোমবার (১ জুন) গণপরিবহন চালুর কথা থাকলেও রোববার (৩১ মে) সকাল থেকেই নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, মুরাদপুর, ২ নম্বর গেইট, জিইসি মোড়, একেখান, আন্দরকিল্লা, বহদ্দারহাট এলাকায় গাদাগাদি করে অতিরিক্ত যাত্রী ঝুলিয়ে রীতিমত ‘শো-ডাউন’ করেছে বেশকিছু গণপরিবহন।