প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরার মতো প্রাকৃতিক ঘটনায় প্রভাবিত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া জলবায়ু অভিবাসীদের দায়িত্ব বিশ্বকে অবশ্যই ভাগ করে নিতে হবে। ক্ষতির বিষয়টি অবশ্যই সঠিকভাবে সমাধান করতে হবে। স্কটিশ পার্লামেন্টে ‘কল ফর ক্লাইমেট প্রসপারিটি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশে ইতিমধ্যে জলবায়ু বাস্তুচ্যুত ৬০ লাখ মানুষ রয়েছে। আরও অতিরিক্ত ১.১ মিলিয়ন মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বোঝা যোগ হয়েছে। কভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলা এ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় স্কটিশ পার্লামেন্টে কমিটি কক্ষে ‘এ বাংলাদেশ ভিশন ফর গ্লোবাল ক্লাইমেট প্রসপারিটি’ শিরোনামে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করছিলেন তিনি। আরও উপস্থিত ছিলেন শেখ রেহানা ও সিভিএফ দূত সায়মা ওয়াজেদ হোসেন।
স্কটিশ পার্লামেন্টে পৌঁছালে স্পিকার অ্যালিসন জনস্টোন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান।
শেখ হাসিনা উল্লেখ করেন যে, কার্যকর ও পর্যাপ্ত জলবায়ু অর্থায়ন হবে সমৃদ্ধি অর্জনের মূল চাবিকাঠি। তিনি এমসিপিপি সফলভাবে বাস্তবায়নের জন্য কিছু প্রস্তাবনা পেশ করেন।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) এবং ভালনারেবল২০ (ভি২০) সভাপতি শেখ হাসিনা একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেছেন, প্রধান কার্বন নির্গমনকারী দেশগুলোকে অবশ্যই ব্যাপক ভিত্তিক এনডিসি (জাতীয়ভাবে নির্ধারিত অবদান) পেশ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। উচ্চাভিলাষী প্রভাব প্রশমন প্রয়াস ছাড়া, শুধুমাত্র অভিযোজন ব্যবস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবগুলোকে ধীর, বন্ধ এবং পাল্টানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
আরেকটি প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, উন্নত দেশগুলোকে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ওপর বিশেষ মনোযোগ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলার প্রদানের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অবশ্যই পূরণ করতে হবে।
সঙ্গে যোগ করেন, ‘অভিযোজন ও প্রভাব প্রশমনের ক্ষেত্রে জলবায়ু অর্থায়ন বিতরণে মধ্যে ৫০:৫০ অনুপাত থাকা উচিত।’
সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী উন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সাশ্রয়ী মূল্যে সবুজ প্রযুক্তির প্রসারের পরামর্শ দেন।
তিনি সম্প্রতি প্রকাশিত আইপিসিসি (জলবায়ু সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল) ৬ মূল্যায়ন প্রতিবেদনটিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব ও জলবায়ু দুর্যোগ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বিশ্বের জন্য আরেকটি জাগরণের আহ্বান হিসেবে উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মানবজাতির সবচেয়ে গুরুতর বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। বাংলাদেশের মতো জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জন্য এটি একটি বড় হুমকি। যদিও আমরা বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমনের ক্ষেত্রে ০.৪৭ শতাংশের কম অবদান রাখি।
তিনি বলেন, চরম তাপমাত্রা, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরা, অধিকতর তীব্র গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঘূর্ণিঝড়, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, ঋতু পরিবর্তন, নদী ভাঙন, সমুদ্রের অম্লকরণ বাংলাদেশ ও অন্যান্য জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর লাখ লে মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধিকে বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ১ মিটার বেড়ে গেলে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রতি বছর বাংলাদেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ শতাংশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাবে নষ্ট হয়ে যায় এবং আগামী দশকে তা নয় শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব অর্থায়নে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড (বিসিসিটিএফ) প্রতিষ্ঠা করেছে। এই তহবিলের আওতায় বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৪৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগসহ ৮০০টি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা প্রধানত অভিযোজন, প্রভাব প্রশমন এবং জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত গবেষণার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে।
আরও বলেন, ‘আমরা একটি নিরাপদ, জলবায়ু সহিষ্ণু এবং সমৃদ্ধ ব-দ্বীপ অর্জনের জন্য অভিযোজিত ব-দ্বীপের ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়া লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মাধ্যমে ধীরে ধীরে ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি ব্যাপক ভিত্তিক ১০০ বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০’ গ্রহণ করেছি। বর্তমানে, দেশ অগ্রসর হচ্ছে এবং একটি জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে (এনএপি) যা আমাদের অভিযোজন উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ গত ২৬ আগস্ট একটি হালনাগাদ এনডিসি সংশোধন করে জমা দিয়েছে। এতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব প্রশমন লক্ষ্যমাত্রার পাশাপাশি নিঃশর্ত ও শর্তসাপেক্ষ অবদান বৃদ্ধি পাবে।
তিনি স্কটিশ পার্লামেন্টে আরও বলেছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাসের পাশাপাশি সবুজ জ্বালানির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। আমরা সম্প্রতি ১২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ সাপেক্ষ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দশটি প্রকল্প বাতিল করেছি।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে শক্তি উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশের পরিকল্পনার উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছে যে, ৬.৫ মিলিয়ন পরিবারে গার্হস্থ্য ব্যবহারের জন্য সৌর শক্তি রয়েছে, যা সারা বিশ্বের অফ-গ্রিড সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় একটি অংশ।
তিনি বলেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের লক্ষ্য রয়েছে আমাদের ৪০ শতাংশ শক্তি নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপন্ন করার। আমরা আমাদের মাস ট্রানজিট সিস্টেমের জন্য বৈদ্যুতিক লোকোমোটিভও সংগ্রহ করছি। এতে আমাদের কার্বন নির্গমন আরও হ্রাস পাবে। বাংলাদেশ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বৈদ্যুতিক গাড়ি চালু করবে। এই গাড়িগুলোর জন্য সারা দেশে চার্জিং স্টেশন স্থাপন করা হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনকালে সরকার সারা দেশে ৩ কোটি বৃক্ষরোপণ করছে।
আরও বলেন, উপরন্তু, বজ্রপাতে মৃত্যুর ঝুঁকি কমাতে সরকার ৫.৪ মিলিয়ন তাল গাছ রোপণ করেছে, যা কার্বন হ্রাসে আরও অবদান রাখছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জলবায়ুর প্রতিকূল ঝুঁকির ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান ঝুঁকি সত্ত্বেও আমাদের ঝুঁকি কাটিয়ে ওঠার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। আমরা আমাদের ঝুঁকি থেকে সহিষ্ণুতা এবং তা থেকে থেকে সমৃদ্ধির দিকে যাওয়ার লক্ষ্যে আমাদের গতিপথ নির্ধারণ করেছি।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ শিগগিরই নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও জলবায়ু সহনশীল উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে অর্থায়নের জন্য জাতির পিতার নামে নামকরণ করা একটি কৌশলগত বিনিয়োগ কাঠামো ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’ চালু করবে।
তিনি আরও বলেন, এই জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনায় রয়েছে অফশোর পাওয়ার জেনারেটিং উইন্ড টারবাইন স্থাপন, শ্রমশক্তির দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদ্যমান জীবাশ্ম জ্বালানি ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সংস্কার, স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন কেন্দ্র তৈরি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে উদ্ভাবনী সমাধান বের করা। জলবায়ু সংক্রান্ত রোগের দিকে মনোযোগ দিয়ে মানসিক এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে।
এ লক্ষ্যে তিনি বলেন, মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়নকালে আমাদের ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ কে আমলে নেওয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, অভিযোজন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে তার সরকার উপকূলীয় অঞ্চলের পাশাপাশি নদী ভাঙন প্রবণ এলাকায় বাঁধ পুনর্নির্মাণ ও শক্তিশালী করারও পরিকল্পনা করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা এই বাঁধগুলোতে সোলার প্যানেল এবং বায়ু টারবাইন স্থাপন করার আশা করছি৷ নেট মিটারিং সিস্টেম এমনকি বসতবাড়িতে স্থাপন করা সোলার প্যানেল জাতীয় গ্রিডে অবদান রাখতে পারে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ এমসিপিপি’র মাধ্যমে প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন খাতে পরিবর্তন ঘটাতে পারে।
সূত্র : দৈনিক পূর্বকোণ
Discussion about this post